ক্যাপশন যুক্ত করুন |
একসময় মন খারাপ হলে কুয়াশা হতো, মেঘ জমত, বৃষ্টি হতো, এখন ভূমিকম্প হয়। খানিক আগেই ঢাকায়, ছোট বোন মণি'র সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে জানলাম, জাপানে নাকি আবার ভূমিকম্প হয়েছে। কোথায়, কতটা সেসব সেও বলতে পারল না, সকাল থেকে খবর দেখার বা শোনার সময় পায়নি। চিন্তায় আছে, ছুটকিটা যে জাপানেই থাকে। না। খবর আমিও দেখিনি বা শুনিনি। সময় পাইনি এমন নয়, টেলিভিশন চালানোর ইচ্ছেটাই হয়নি আজ। এখনও হচ্ছে না। তার থেকে বরং ছুটকিকে ফোন করে জেনে নেওয়া যাবে।
আজকে, আমার প্রবল মন খারাপের সময়ে জাপানে যখন ভূমিকম্প হলো, আম্মার জন্যে আমার খুব মন কেমন করে উঠল। ভীষণ রকম মনে পড়ল মায়ের কথা। মনে হলো, কতদিন দেখি না আম্মাকে। সত্যিই তো। দিন তারিখের হিসেব করলে দেড় বছর হয়ে গেল আম্মাকে দেখেছি। দিন পাঁচ-ছয় আগেই ফোনে কথা হয়েছে, চাচিআম্মা মারা যাওয়ার পর তিন-চারবার কথা হয়েছে, তাও মনে হলো অনেকদিন কথা হয়নি। এমনিতে যে আম্মার সঙ্গে সব সময় কথা হয় তেমনটা নয়। আম্মার ফোন অধিকাংশ সময়েই বেজে যায়, আম্মা হয়ত তখন রান্নাঘরে বা একতলায়। বাড়িতে কথা বলার হলে কল যায় তাই আব্বার ফোনে। এমনিতেও গল্প যা হওয়ার তা সব সময়েই আব্বার সঙ্গেই হয়। ফোন যখন করি বেশিরভাগ সময়েই আব্বা নিচে, পুকুরপাড়ে, সেগুন গাছের তলায় হাতলওয়ালা বড় বেঞ্চিতে। এয়ারটেল কম্পানি যখন ব্যালেন্সের হিসেব দিতে থাকে তখন ফোনটা রেখে দিই। যখন এমন হয় যে, অনেকদিন আম্মার সঙ্গে কথাই হয় না, আব্বাকে সেটা বললে আব্বা কাউকে দিয়ে ফোনটা উপরে পাঠিয়ে দেয়।
আজকে আম্মাকে একবারেই পাওয়া গেল। আম্মা বলে ডাকতেই -সামরান, কুন সময় আইবা? আমার যে ভালা লাগে না.. শেষবার যখন কথা হলো, ফোনের ওধারে তখন আম্মা কাঁদছিল, সদ্য মারা গেছে চাচিআম্মা। তারপর থেকেই অসুস্থ মা আমার আরও বেশি অসুস্থ। আমাকে বলল, তুমি কবে আইবা, আমি মইরা গেলে খবর পাইয়া যদি আইও তবে তো লাশও দেখতা পাইবা না, কবর দিয়া দিব.. আম্মাকে বললাম, আপনার মরে যাওয়ার বয়েস হয় নাই, অনেকদিন বাঁচবেন এখন, বাবুর পরীক্ষা শেষ হলেই আসব, অস্থির হইয়েন না। আম্মা বলে, হ, তোমার চাচিআম্মার যেন মরবার বয়েস হইসিলো!
সত্যিই তো। মরে যেতে তো বয়েস লাগে না। যে কেউ যে কোনো সময়ে যে কোনো বয়েসে মরে যেতে পারে… কত বয়েস হয়েছিল আমার চাচির? ষোল নাকি সতেরো(?) বছরের কিশোরী মেয়েটি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে আমাদের বাড়িতে বউ হয়ে এসেছিল। চল্লিশ বছর পর, স্বাধীনতার চল্লিশ বছর পুর্তির দিনে চলে গেল। চল্লিশ বছরের সংসারজীবন একত্রে কাটিয়েছে আম্মা আর চাচি। আব্বা বলল, তখন যুদ্ধ চলছে, তোমার চাচিআম্মারা নিজেদের বাড়ি ঘর সব ছেড়ে-ছুঁড়ে পালিয়ে গিয়ে নর্হায় উঠেছিল খানসেনাদের ভয়ে, সেখানেই বিয়ে। একটা নৌকায় করে বিয়ের নওশা সহ তিনজন বরযাত্রী। দাদা, আব্বা আর নওশা। ছইওলা কোনো নৌকাও পাওয়া যায়নি যাতে করে বরযাত্রী যাবে, নতুন বউ আসবে। বিয়ের বাজার বলতে খুঁজে পেতে বাজার থেকে কিনে আনা চৌদ্দ টাকা দামের একটা শাড়ি আর একটা গামছা।
বয়েসের কথা আসতে মনে পড়ল, আম্মার বয়েস কত হলো? আমরা কেউ তো আম্মার জন্মদিনও জানি না! জ্ঞান হওয়ার আগেই বাপ-মা দুজনকেই হারিয়ে মামার বাড়িতে মানুষ হওয়া মা আমার নিজের জন্মদিনও জানে না.. ও বললো, একটা ভাল দিন দেখে মায়ের জন্মদিন পালন করো না কেন সবাই মিলে? সত্যিই তো! মণিকে বললাম, সামনে পয়লা বৈশাখ, সেদিন সবাই মিলে আম্মার জন্মদিন পালন করা হোক। আমি তো যেতে পারব না, তুই সেদিন বাড়ি যাবি, আম্মার জন্যে সুন্দর একটা শাড়ি কিনবি, বাড়ি গিয়ে পায়েস রাঁধবি আর ঢাকা থেকে নিজে কেক বানিয়ে নিয়ে যাবি। ভাইয়াকে, টুটুলকে, বাবলিকে, মুন্নাকে সব্বাইকে বলে দে, সেদিন যেন বাড়ি আসে, যেমনটা আব্বার জন্মদিনে সবাই আসে। এবার থেকে পয়লা বৈশাখ আমার মায়ের জন্মদিন...
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন