আমার উচ্চতায় ভয়। চারতলা বাড়ির ছাদের রেলিং দিয়ে নিচের দিকে তাকালেও ভয় লাগে, তলপেট কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে, বুক ঢিপঢিপ। সেদিন সকালে হাঁটতে গিয়ে আন্দুলের দিকে যাওয়া অনেকটা উঁচু ফ্লাইওভারের রেলিংএর ধারে গিয়ে ভয়ে ভয়ে দাঁড়াই। নিচের দিকে তাকিয়ে চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ফ্লাইওভার আর তার মাঝে মাঝে আরও নিচে ফাঁকা জায়গা, সরু রাস্তার দিকে দেখতে গিয়ে আজ কেন কে জানে ভয় করল না। বরং ফ্লাইওভারের ফাঁক-ফোকরে পড়ে থাকা নিচের ফাঁকা জমি, এঁকে বেঁকে এগিয়ে যাওয়া সরু রাস্তা যেন আমায় ডাকল! একটা শিরশিরে ভাব.. অনেক অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকি নিচের দিকে, একটুও ভয় করে না আর..
আমরা প্রতিদিনই কতবার নিচে নামি, উপরে উঠি। সিঁড়ি দিয়ে নামি, কেউ কেউ লিফ্টে করে নামেন, ব্রিজ থেকে নামি, আবার উঠিও। যে সিঁড়ি দিয়ে নামি, সেই সিঁড়ি দিয়েই আবার উপরেও উঠে আসি, এতে নতুন কিছু নেই। কেউ কোনো খারাপ কাজ করলে বা করে থাকলে আমরা বলি, অমুক কত নিচে নেমে গেছে, বা গিয়েছিল। সেই একই মানুষ কোনো ভাল কাজ করলে কী আমরা বলি যে অমুক বা এই মানুষটা কত উপরে উঠে গেছে? হয়ত কেউ কেউ বলে থাকেন, আমি জানি না। এই উপরে ওঠা বা নিচে নামা- একই শব্দ অথচ কত তফাৎ এর ব্যবহারিক অর্থে!
০২
তারে স্মরণ ও করি না/ স্বপনেও দেখি না আমি/ এ আমি সঙ্গে সঙ্গে/ এই অঙ্গে অঙ্গে রাখি আমি সারাক্ষণ- কফিল আহমেদ
আর যাব না ঠাকুরবাড়ি/ আমার রাধার নাইরে শাড়ি- গানটি সম্ভবত কফিল আহমেদেরই লেখা, সুর করা আর গাওয়া তো বটেই। সম্ববত এজন্যে বললাম, উনি গান বাঁধেন, গান করেন, কিন্তু ঠিক এই গানটি ওনারই লেখা কিনা ঠিক জানি না। সাগরকে জিজ্ঞেস করলে এক্ষুণি জানতে পারা যায় কিন্তু কি দরকার.. এমন কিছু জরুরী তো নয়.. অনেকদিন, অনেকবার গানটি অনেকভাবে অনেক জায়গায় শুনেছি, কফিল আহমেদ নিজেও গেয়ে শুনিয়েছেন। প্রতিবারেই একটা প্রশ্ন মাথায় জেগেছে, ‘ঠাকুরবাড়ি’ কেন? অন্য কোনো জায়গা বা বাড়ি নয় কেন? দিন দুই ধরে থেকে থেকেই প্রশ্নটা গোত্তা মারছে মাথায়। কফিল আহমেদের সঙ্গে দেখা হলে জিজ্ঞেস করতে হবে..
০৩
পুরানো সেই দিনের কথা সে কি ভোলা যায়
স্মৃতি যে সততই মধুর হয় এমনটা নয়। প্রচুর টক-ঝাল-নোনতা-মিষ্টি স্মৃতিদের সঙ্গে সঙ্গে থাকে অনেক অনেক তিক্ত স্মৃতিও। চিরতার পানির চাইতেও বেশি তেতো হয় কখনও কখনও সেসব। তবুও মনে পড়ে। হঠাৎ হঠাৎ আপনা থেকেই। কোনো ছোট্ট একটা টুকরো কথা বা কোনো জিনিস খুলে দেয় স্মৃতির পুরো ঝাঁপিটাকে। যা হয়ত মনে করতে চাই না, দুঃস্বপ্নেও দেখতে চাই না। আবার কখনও বা কেউ মনে করিয়ে দেয়, খেই ধরিয়ে দেয় মনের গহীন কোনো অন্দরে ঘুমিয়ে থাকা, কোনো ভুলে যাওয়া বা ভুলতে চাওয়া স্মৃতি-ঘটনা। বহুকাল আগে একটা কথা শুনেছিলাম, গ্রাম্য এক প্রবাদ- ছোট্ট এক পিঁপড়ের কামড় নাকি কখনও কখনও চেপে থাকা সাপের বিষকে জাগিয়ে দেয়। আমরা ভাবি, যে দিন গেছে, সে গেছে। ফুরিয়ে গেছে, হারিয়ে গেছে। কিন্তু যায় কী আসলেই?
যায় না। কিছুই হারায় না। যখন তখন ফিরে আসে। কখন, কীভাবে-কেউ জানে না... জীবনের ধন নাকি কিছুই যায় না ফেলা.. স্মৃতিও তেমনি, কিছুই হারায় না, হারিয়ে যায় না..
০৪
আমার এই জ্বরবেলা…
আমার বড় জ্বর হয়। জীবন জুড়িয়া কেবলি জ্বর। মাঝে-মধ্যে জ্বর থাকে না, তখন ঘুরে বেড়াই, দৌড়ে বেড়াই। একটু বেশিই দৌড়ে বেড়াই। কারণে বা অকারণে। আবার জ্বর হয়, আবার আমার নক্শী কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকা, ক্যাল্পোল বা ক্রসিন ট্যাব। জ্বরের ফাঁকে ফাঁকেই সংসার, ছেলে-মেয়ে। কাঁথাটা এমনিতে সারাবছরই বিছানায় থাকে, ভাঁজ করা, বিছানার ধার ধরে। এবার শীত পড়ার সময়ে সে যে খাটের ভেতরকার বাক্সে ঢুকেছে আর বেরোয়নি। এখন আমার গায়ে মায়ের দেওয়া নক্কশী চাদর। গোটা চাদর জুড়ে কাঁথার ফোঁড়ে ফুল, লতা পাতার রংবাহারি নক্শা। বেশ মোটা চাদরটা, দু’ভাঁজে গায়ে থাকলে আর ঠান্ডা লাগে না। কাঁথার মতো ওম নেই যদিও কিন্তু মায়ের দেওয়া চাদরে যেন মায়ের হাতের ছোঁওয়া লেগে আছে এখনও। সেবার বাড়িতে গিয়ে আম্মার খাটে পাতা এই চাদরটা দেখে জানতে চেয়েছিলাম, কে করেছে কাজটা? বড় সুন্দর! কার একটা নাম যেন বলেছিল আম্মা, যাকে দিয়ে চাদরে কাজটা করিয়েছে। জিজ্ঞেস করলো, তুমার পছন্দ হইছে চাদরটা? 'বড় সুন্দর' বলাতে সঙ্গে সঙ্গেই বিছানায় পাতা চাদরটা তুলে ভাঁজ করে আমার ব্যাগে ঢুকিয়ে দিয়েছিল আম্মা বারবার বারণ করা সত্বেও।
জ্বরটা এমনি এমনি হয়। কারণে বা অকারণে, যখন তখন। কখনো ভালুকজ্বর তো কখনো ঘুসঘুসে। দুঃখু পেলে জ্বর হয়, কষ্ট পেলে হয়, কোনো ভাবনা চিন্তা একটু চেপে বসলে জ্বর হয়, ঠান্ডা লেগে সর্দিজর, সিজন চেঞ্জ ইত্যাদি বা ম্যালেরিয়াও আছে। সে সব অবশ্য কম-বেশি সকলেরই হয়। আমার বাড়ির সকলেই মোটামুটি এইসব জ্বর-জ্বালা নিয়ে অভ্যস্ত বলে কেউই খুব একটা মাথা ঘামায় না এখন আর। বাবা-মা বা ভাই বোনেরা খবর পেলে অবশ্য চিন্তায় পড়ে যায়, তবে বেশির ভাগ সময়েই ওরা জানতে পারে না। রোজ রোজ কত আর অসুখ অসুখ করব। ফোনে বোন তবু গলার আওয়াজে বুঝে যায়, বলে, তোমার এমন বারো মাসই জ্বর থাকে কেন? যখনই ফোন করি, তোমার জ্বর! বললাম, না না, বারো মাসই থাকে এমন নয়, মাঝে মধ্যেই জ্বর থাকে নাঃ-)
জ্বর হলে বড় মা’কে মনে পড়ে। ছেলেবেলাকে মনে পড়ে। হয়ত বড়বেলার সব জ্বরে তো একলা থাকার বেলা বা পালা বলেই মা’কে বেশি বেশি করে মনে পড়ে। ছেলেবেলায় হওয়া জ্বর আর মা। নরম করে রাঁধা গরম ভাতে পানি দিয়ে কচলে ভাতটা ফেলে দিয়ে সেই পানিতে নুন আর লেবুর রস দিয়ে চামচে করে খাইয়ে দেওয়া। বিছানার ধার ধরে অয়েলক্লথ পেতে তাতে বালিশ রেখে সেই বালিশে শুইয়ে মাথায় পানি ঢালা, মাথা এপাশ ওপাশ করিয়ে ঘাড় অব্দি ধুইয়ে দেওয়া, মাঝে মধ্যেই মিশ্র মশলার গন্ধ মাখা ভেজা হাতে মুখ মুছে দেওয়া, হাতের আঁজলায় করে পানি নিয়ে দুই চোখেও পানি দেওয়া আর ততক্ষণ পানি ঢালতেই থাকা যতক্ষণ জ্বর না নামছে। তখন, হাতের ওই মশলার গন্ধ বড় নাকে লাগত। তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছিয়ে দিয়ে আঁচলে করে মুখ..
..বুকের ভেতর দলা পাকায় কষ্ট, কবে কখন কোথায় যে হারালো মধুর সেই জ্বরবেলা ..
জ্বর হলে বড় মা’কে মনে পড়ে। ছেলেবেলাকে মনে পড়ে। হয়ত বড়বেলার সব জ্বরে তো একলা থাকার বেলা বা পালা বলেই মা’কে বেশি বেশি করে মনে পড়ে। ছেলেবেলায় হওয়া জ্বর আর মা। নরম করে রাঁধা গরম ভাতে পানি দিয়ে কচলে ভাতটা ফেলে দিয়ে সেই পানিতে নুন আর লেবুর রস দিয়ে চামচে করে খাইয়ে দেওয়া। বিছানার ধার ধরে অয়েলক্লথ পেতে তাতে বালিশ রেখে সেই বালিশে শুইয়ে মাথায় পানি ঢালা, মাথা এপাশ ওপাশ করিয়ে ঘাড় অব্দি ধুইয়ে দেওয়া, মাঝে মধ্যেই মিশ্র মশলার গন্ধ মাখা ভেজা হাতে মুখ মুছে দেওয়া, হাতের আঁজলায় করে পানি নিয়ে দুই চোখেও পানি দেওয়া আর ততক্ষণ পানি ঢালতেই থাকা যতক্ষণ জ্বর না নামছে। তখন, হাতের ওই মশলার গন্ধ বড় নাকে লাগত। তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছিয়ে দিয়ে আঁচলে করে মুখ..
..বুকের ভেতর দলা পাকায় কষ্ট, কবে কখন কোথায় যে হারালো মধুর সেই জ্বরবেলা ..
প্রত্যেকটা পোস্টে গিয়ে আপনাকে অনুরোধ করা সম্ভব নয়, যে এটি আমার লেখা, আপনার ব্লগ থেকে মুছে দিন।
উত্তরমুছুনআপনি জানেন কোন কোন লেখাগুলো আপনি কোন ব্লগ থেকে নিয়েছেন। দয়া করে মুছে দিন।
ধন্যবাদ